সাত.
আর যে কোনো সংকটে যা হয়, আগাছার মতো গজিয়ে উঠতে লাগল দালালের দঙ্গল। তারা যশোরে হিন্দুদের জমি ও বাড়ি কোলকাতা বা বশিরহাটের মুসলমানদের সঙ্গে পাল্টপাল্টি করে দিতে লাগল। এতে করে কোনো পার্টি জিতল, কোনো পার্টি হারল। কেউ কেউ এমন হারল যে, জীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না।
আমি তখন নেহাতই ছোট। আমি বাবার কাছে নিত্য নতুন মানুষজনের আনাগোনা করতে দেখি। তারা যেন বাবার পরামর্শ চায়। সাহায্য চায়। বাবাকে শুনি রাতের বেলা মায়ের কাছে গুনগুন করতে। আজ ওমুক চলে গেল। এত মানা করলাম যেতে তবু শুনল না। বনগাঁয় নাকি তার বোনের ছেলে থাকে। আমার ভালো লাগে না।
এসবের ভেতরেই একদিন বাবা আমাদের অনেক দূরে একটি গ্রামের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সেখানে চারপাশে প্রচুর গাছগাছালি। পাখি ডাকছে। গরু চরে বেড়াচ্ছে উঠোনে। সারবাঁধা নারকেল গাছে ডাব ঝুলে আছে। সারবাঁধা খেজুর গাছে মাটির ঠিলা বাঁধা আছে। মস্তবড় খোলা গোবর-মাটিলেপা উঠোনে খড়ের ঢিবি। দেখে আমি তো অবাক কিন্তু আমার মা-বাবা অবাক নন। বাবা বললেন, এই জমিটা আমি কিনেছি। এটা হবে আমাদের বাগানবাড়ি।
বাড়ি দেখে আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি। বাবা বললেন, আমরা মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকব। কিন্তু এই বলা পর্যন্তই। এরপর আমি আর কোনোদিন সেই জমিতে যাইনি। আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা অনেকবার গিয়েছে কিন্তু আমি সেই একবারই। তারপর অনেক বড় হয়ে গিয়েছি, যখন বাবা-মা কেউই জীবিত নেই।
দেশভাগ হয়ে গেছে। তবে পাসপোর্ট সিস্টেম তখনও চালু হয়নি। ভারত থেকে প্রচুর মোহাজের যশোর আসছে। আমাদের বাবা যিনি একেকসময় একেক রকমের ব্যবসা করতেন, এখন তিনি সরকারের ঘরে রেজিস্ট্রিকৃত প্রথম সারির কন্ট্রাক্টর। তিনি ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্যে বাড়িঘর নির্মাণ করছেন। রাতদিন বাবা এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি যশোরে আর থাকেন না। থাকেন রাজার হাট বা মনিরামপুর বা যেখানে যেখানে কাজ হচ্ছে।
এদিকে আমি বসে গিয়েছি গল্প-কবিতা লিখতে! বড় বড় গল্পের বই পড়ছি। ভ্রমণ কাহিনী পড়ছি। বড় মানুষদের আত্মজীবনী পড়ছি। আবার স্কুলের পড়াও পড়ছি। মাকে আমি সাফ বলে দিয়েছি—আমি লেখক হব। আমি গল্প, কবিতা লিখব। আমি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করব। তখন আমার একটা সিরিয়াস কাজ ছিল বাড়িতে খবরের কাগজ এলে সেই কাগজ থেকে যেসব মেয়েরা বিলেত যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার জন্যে, তাঁদের ছবি কেটে কেটে আঁঠা দিয়ে আমার খাতার পাতায় সেঁটে রাখা। এরকম করে রাখতে রাখতে আমার খাতা প্রায় অর্ধেক এসে গেছে। যেসব মেয়েদের ছবি আমি কেটে রেখে আমার খাতায় সেঁটেছি, তাদের চেহারা একভাবে দেখতে দেখতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। আশ্চর্যের বিষয় এইটা ছিল যে, আমাদের পাড়ায় কারও বাড়িতে কোনো খবরের কাগজ না এলেও আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন খবরের কাগজ আসত। আমার বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। এতে বোঝা যায়, দেশের রাজনীতি এবং হালচালের খবর জানতে তিনি উৎসুখ ছিলেন।
দুপুরের খাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন তিনি মেঝেয় মাদুর পেতে একটু বিশ্রাম নিতেন। তখন আমার কাজ ছিল বাবার মাথা থেকে শাদা চুল বের করে মাথা কালো রাখা। খুব একটা চুল তখনো পাকেনি কিন্তু বাবা বলতেন, চুল হাটকে দ্যাখ, ভেতরে অনেক পাকা চুল খুঁজে পাবি! আমি তাঁর মাথার পাকা চুল তুলে দেবার সময় বাবা খবরের কাগজ খুলে আপনমনে পড়তেন। তবে সপ্তাহে যে সাহিত্যের পাতা বেরোতো সেদিকে আমার বাবার বিন্দুমাত্র ঝোঁক ছিল না। পাতাটাকে সযত্নে সরিয়ে রেখে তিনি খবর পড়তেন। এমনি যখন একদিন তিনি পেপার পড়ছেন আর আমি তাঁর মাথার পাকাচুল তুলে দিচ্ছি। তিনি কী কারণে জানি না চেঁচিয়ে একটি খবর পড়তে লাগলেন। খবর তো নয়, সাহিত্য সাময়িকীর একটি গল্প। আর সেই গল্পটি আমার লেখা। সেই কতদিন আগে খবরের কাগজে পাঠিয়েছিলাম। তারপর ভুলেও গিয়েছি। আর সেদিনের সাময়িকীতেই সেটি ছাপা হয়েছে। জীবনের প্রথম বড়দের পাতায় এবং আমার বাবাই সেই গল্প জোরে জোরে আপনমনে পড়ছেন। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছি—আরে এটাতো আমার লেখা বলে মনে হয়। সেই কবে পাঠিয়েছিলাম। খুব সম্ভব সংবাদ পত্রিকায়।
বাবার পাঠ শুনে আমার শরীর রোমাঞ্চিত, নিঃশ্বাস রুদ্ধ, হতবাক। আমি থাকতে না পেরে বললাম—বাবা, এটাতো আমার লেখা! আর বাবা সেকথা শুনে কিছু না বলে পড়া বন্ধ করে দিলেন। আমাকে কিছু বললেন না। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁরও মনে প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল। নতুবা এত লেখা থাকতে তিনি কেন আনোয়ারা বেগম নামে লেখকের লেখা জোরে জোরে পড়বেন? তখন তো আনোয়ারা বেগম নামে লিখতাম। তারপর আনোয়ারা বেগম চৌধুরী নামে লিখতাম। সবশেষে আনোয়ারা সৈয়দ হক। এই ঘাটে ঘাটে নাম পাল্টানো। এতেও আমার চরিত্রের অস্থিরতা ওজন করা যায়। উচিৎ ছিল প্রথম থেকেই ছদ্মনামে লেখা, যেমন বনফুল কিন্তু সেসময় তেমন বুদ্ধি আমার ছিল না।
মফস্বল শহর বলে সেসময় প্রতিদিনের কাগজ প্রতিদিন হাতে পেতাম না। একদিন পরে খবরের কাগজ হাতে পেতাম। ইংরেজি এবং বাংলা দুই রকমেরই কাগজ হাতে আসত। বাড়িতে বাবা ছাড়া কেউ খবরের কাগজ হাত দিয়েও ছুঁতো না। এমনকি আমার বড় বোনও নয়। কিন্তু বাবার দেখাদেখি আমি খবরের কাগজ পড়তাম। যতটা না পড়া তার চেয়ে নিজেকে গম্ভীর দেখানোটাই ছিল বিশেষ উদ্দেশ্য। আর বুঝি বা না বুঝি চিৎকার করে ইংরেজি পেপার পড়তাম। আমাদের বাড়ির হলঘরেই ছিল স্কুলঘর। এই স্কুলঘরেই তখন মোহনগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলটা বসত। আমার দাদার আমলেই স্কুলটা বসানো হয়েছিল। পরে আমার বাবা যখন ঘরবাড়ি ভেঙে দোতলা করবেন তখন বড়বাবার জমিতে স্কুলঘরটা উঠে যায়। এখন পর্যন্ত স্কুলটি সেখানেই আছে। সেটি এখন সরকারি অনুদানে চলে।
তো আমার চেঁচিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ার জন্যে কার কি সুবিধে হতো জানিনে কিন্তু অসুবিধে হতো প্রচুর। কারণ আমার জোরে জোরে ইংরেজি পড়বার জন্যে বন্ধ জানালার ওপাশে বাচ্চাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত! পরে সেটা বুঝতে পেরে আমার চেঁচিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজ পড়া বন্ধ হয়! এখন বড় হয়ে বুঝি—বাড়িতে খবরের কাগজ রাখবার জন্যেই বুঝি আমার এরকম বই পড়ার নেশা হয়। নইলে আমাদের বাড়িতে বই বলতে কিছুই ছিল না। এমনকি ধর্মীয় কোনো বইও নয়। আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ছিল পাবলিক লাইব্রেরি কিন্তু সেখানে যাবার সৌভাগ্য আমার বেশি হয়নি। কে আমাকে নিয়ে যাবে? বাড়ি ছেড়ে একা একা বেরোবার কোনো আদেশ ছিল না। তাই এর কাছ থেকে, ওর কাছ থেকে বই চেয়ে নিয়ে পড়তাম। সেভাবেও প্রচুর বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু আমার বইপড়ার নেশার বিন্দুমাত্র রসদ জোগায়নি আমার এমএসটিপি গার্লস স্কুল। বর্তমানে যেখানে কলেজও যোগ হয়েছে।
স্কুলে বিরাট একটি বইয়ের লাইব্রেরি ছিল কিন্তু সেটা কখনো খোলা হতো না। বরং পাছে স্কুলের মেয়েরা লাইব্রেরির বই চোখে দেখে ফেলে এবং আবদার ধরে বই নেবার। সেই ভয়ে বছরে দুবার করে স্কুলঘর ঝাড় দিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হতো। মজার বিষয়, স্কুলের শিক্ষকদেরও আমি কোনোদিন সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তে দেখিনি। সেখানে একটানা দশ-দশটা বছর আমি পড়েছি। কোনোদিন তাঁদের লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে দেখিনি! শিক্ষকদের নিজেদেরও সখ ছিল না বই পড়ার। তো সেসব শিক্ষকদের হাতে আমরা মানুষ হয়েছি। ফলে অর্ধেকও মানুষ হতে পারিনি বলে আমার বিশ্বাস। মানুষ হলে বড়জোর সিকি মানুষ হয়তো হতে পেরেছি!
রাতে বই পড়তে গেলে অনেক সময় আলো পাওয়া যেত না। বাড়িতে হ্যারিকেনের অপ্রতুলতা ছিল। আমি ছিপ ফেলে বসে থাকতাম কখন বাড়ির সকলে ঘুমোতে যাবে। তারপর হ্যারিকেনের নিভুনিভু আলো আমার মশারির নিচে এসে জ্বলে উঠবে। তখন আমি পড়তে বসব ‘মরুতীর্থে হিংলাজ’। মাঝে মাঝে হ্যারিকেনে তেলের অভাব হয়ে যেত। তখন আমার কাছে লুকিয়ে রাখা মোমবাতি জ্বলে উঠত গোপনে। সেই মোমবাতির আলো কড়ি দিয়ে কিনলাম। ব্যাপরটা খুব রিস্কি ছিল সন্দেহ নেই। যে—কোনো সময় মশারিতে আগুন ধরে যেতে পারত। কিন্তু জীবনের ধারা এই যে, নো রিস্ক্ তো নো গেইন!
১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামে এক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম রফিকউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। তার বাবা খুবই ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তাকে ছোটবেলায় কঠিন পর্দা ও অন্যান্য ইসলামী শরিয়ত মেনে চলতে হতো। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে যশোরে।
তার পাঠদানের হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। মধুসূদন তারাপ্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। কলেজ গ্রন্থাগারে প্রচুর বই থাকলেও তিনি তা অধ্যয়নের সুযোগ পান নি। সে সময়ে শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই পড়ারই সুযোগ পেত। তাই মাঝে মাঝে উপন্যাস, ম্যাগাজিন ও অন্যান্য সাহিত্য পেলে তারা নিজেদের ধন্য মনে করত। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাইলেও তার বাবার আগ্রহে তাকে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। পরে ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডনে যান। তিনি সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে এমআরসি ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরে আসেন।
এমবিবিএস পাস করার পর তিনি তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে মক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সম্পূর্ন নয় মাস তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা এয়ারবেসের মেডিক্যাল সেন্টারে তিনি চিকিৎসা করেছেন সৈনিকদের এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের। ১৯৭৩ সালে তিনি বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে ইস্তেফা দিয়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে এসে ১৯৮৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকার মানসিক স্বাস্থ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও প্রভাষক। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর নেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রভাষক ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।
তার প্রথম ছোটগল্প পরিবর্তন ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিত দৈনিক ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে লিখতেন। মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়াকালীন দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও গুলিস্তা পত্রিকায় তার লেখা গল্প, কবিতা প্রকাশিত হতো। গুলিস্তা পত্রিকায় লিখে তিনি পুরষ্কৃতও হয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির পাশাপাশি তিনি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে তার লেখা ছাপা হতো। তার প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার সেই প্রেম সেই সময় ও বাজিকর উপন্যাসে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। নরক ও ফুলের কাহিনী উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। বাড়ি ও বণিতা উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা। উপন্যাস ছাড়া তিনি শিশুদের জন্য সাহিত্য রচনা করেছেন। ১৯৭৭ সালে ছানার নানার বাড়ি, বাবার সাথে ছানা (১৯৮৬), ছানা এবং মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৭), ১৯৯০ সালে তৃপ্তি, আবেদ হোসেনের জোৎস্না দেখা, ১৯৯২ সালে হাতছানি, আগুনের চমক এবং মুক্তিযোদ্ধার মা নামক শিশুতোষ গল্প ও উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়।
তিনি ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে সৈয়দ শামসুল হকের অনুপম দিন, শীত বিকেল, সম্রাটের ছবি, এক মহিলার ছবি, দেয়ালের দেশ পড়ে তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন। তিন পয়সার জোসনা গল্পটি পড়ার পর তিনি সৈয়দ হককে চিঠি লিখেন। সৈয়দ হক এক মাস পর সেই চিঠির জবাব দেন। এরপর প্রতিনিয়তই তারা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে থাকেন। একদিন সৈয়দ হক তাকে ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলের চিন-চাও রেস্তোরায় দেখা করতে বলেন। প্রথম সাক্ষাতে সৈয়দ হক তাকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা লিখেন। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন তারা ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। ১৯৬৫ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি সৈয়দ হকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সৈয়দ হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফুসফুসের কর্কটরোগ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে বিদিতা সৈয়দ হক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক একজন আইটি বিশেষজ্ঞ, গল্পকার ও গীতিকার। তিনি যুক্তরাজ্যের রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে এমবিএ পাস করেন।
ছোটগল্প
• পরিবর্তন (১৯৫৪)
• পারুলীর উড্ডয়ন
• হেলাল যাচ্চিল রেশমার সাথে দেখা করতে
• গলে যাচ্ছে ঝুলন্ত পদক
• অন্ধকারে যে দরোজা
• মানসিক সমস্যার গল্প
• শূন্যতার সাথে নৃত্য
• গুজরিপঞ্জম
• গ্রাম গঞ্জের গভীরে
• পূর্ণিমায় নখের আঁচড়
• সূর্য ওঠার গল্প
উপন্যাস
• তৃষিতা (১৯৭৬)
• সোনার হরিণ (১৯৮৩)
• সেই প্রেম সেই সময়
• বাজিকর
• জলনুড়ি
• তারাবাজি
• হাতছানি
• উদয় মিনাকে চায়
• অস্থিরতার কাল, ভালোবাসার সময়
• ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে
• নরক ও ফুলের কাহিনী
• বাড়ি ও বনিতা
• গা শিরশির (২০১১)
• কার্নিশে ঝুলন্ত গোলাপ
• সেই ভাষণটি শোনার পর
• নিঃশব্দতার ভাঙচুর
• তাম্রচূড়ের লড়াই
• সেইসব দিন
• যোজন দূরের স্বজনেরা
• ঘুম
• খাদ
• আহত জীবন
• আকাশ ভরা
• দুই রমণী
• নারী : বিদ্রোহী
• সবুজ পশমি চাদর
• ব্যবহ্নতা
• আয়নার বন্দী
• নখ
• সন্দেহ
• ঘুমন্ত খেলোয়াড়
• রূপালী স্রোত
• চেমনআরার বাড়ি
কাব্যগ্রন্থ
• কিছু কি পুড়ে যাচ্ছে কোথাও
• তুমি আগে যাবে, না আমি
• স্বপ্নের ভেতর
• তুমি এক অলৌকিক বাড়িঅলা
• কাল খুব কষ্টে ছিলাম
• আমার শয্যায় এক বালিশ-সতীন
প্রবন্ধ
• নারীর কিছু কথা আছে
• কিশোর-কিশোরীর মন ও তার সমস্যা
• যেমন আমাদের জীবন
• ক্ষুব্ধ সংলাপ (২০১১)
• মেয়ে হয়েছি বেশ করেছি (২০১২)
• তোমার কথা
• পিকাসোর নারীরা
শিশুসাহিত্য
• ছানার নানার বাড়ি (১৯৭৭)
• বাবার সাথে ছানা (১৯৮৬)
• ছানা এবং মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৭)
• পথের মানুষ ছানা
• একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে
• আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দাদাভাই
• মন্টির বাবা
• তোমাদের জন্য এগারোটি
• উল্টো পায়ের ভূত
• আমি ম্যাও ভয় পাই
• আমি বাবাকে ভালোবাসি
• হানাদার বাহিনী জব্দ
• মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ছড়া
• ছোটখেলের বীর
• যেমন আমাদের জীবন
• সর্পরাজের যাদু
• আমার মা সবচেয়ে ভালো (২০০৮)
• তুমি এখন বড় হচ্ছো
• টুটুলের মা-গাছ
• উদাসী বালক
• তপনের মুক্তিযুদ্ধ
• কাঠের পা
• আগুনের চমক
• দশ রঙের ছড়া
• মুক্তিযুদ্ধের পাঁচটি উপন্যাস
অনুবাদ
• ল্যু সালোমে : সাহিত্যভুবনের অগ্নিশিখা (২০১২)
স্মৃতিকথা
• অবরুদ্ধ
ভ্রমণকাহিনী
• উড়ে যাই দূরে যাই
পুরস্কার ও সম্মাননা
• ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক-২০১৯
• উপন্যাস শাখায় নৃ প্রকাশনী থেকে ছানা ও নানুজান-এর জন্য পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০১৯
• উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১০
• কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার-২০০৭
• ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার-২০০৬
• অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
• মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
• শিশু একাডেমি পুরস্কার