12th June, 2020 | | 3
কবিতা এক অনুভূতির নাম, সেন্স, যা ভাষার গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নেয়। সেই বিশ্রাম অনন্য। সত্যিকারের হেভেনলি আরকি। শিল্প এই অনন্যতারই ধারণা। জীবন আর প্রকৃতি, মৃত্যু আর জন্ম, স্মৃতি আর স্বপ্ন, ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া, সুখ আর অসুখ, সম্পদ আর দারিদ্র্য, বিলাস আর সংগ্রাম কেউ কারো অনাত্মীয় নয় শিল্পে।
যেভাবে কবিতা হয়, মানে নির্মিতিটাই শিল্প, অনুধ্যানের সন্ধান করে কবিতা আর কবি সেই অনুধ্যান সহযোগে পৌঁছায় কবিতা অব্দি অর্থাৎ সে-ই অনুভূতিটা, Ôযে নিজে ভাষার গায়ে হেলে আরাম করছে বিশ্রামে’, কবি সেই সেন্সটার দেখা পায়, ছোঁয়া পায়, ঘ্রান পায়, স্বাদ পায়।
এই অর্থে কবি একজন সাধক নিজ জগতসংসারে, নিজ ভাষাতে উপবিষ্ট। জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ, হুইটম্যান বা জন মিল্টন, অডেন বা ব্যোদলেয়ার, যে কবিকেই বিশ্লেষণ করুন, দেখবেন—সেখানে এক সন্ধানী সত্তা উপস্থিত। কিসের সন্ধান সেটি?
একই কথা এখানেও, সন্ধান সেই অনন্য সাধারণ অনুভূতির আত্মতত্ত্ব, যাকে বলে মোক্ষ আর এইখানে বাহনের নামটা হলো ভাষা, ধ্বনি-অক্ষর-চিহ্ন সহযোগে।
এই যেমন—এইদিকে বৃষ্টি হলো আজকে। দুপুরের বৃষ্টি। গ্রীষ্মের বৃষ্টি। ‘বৃষ্টি’ বা Ôদুপুর’ বা ‘গ্রীষ্ম’ এই যে একেকটা ধ্বনি-বর্ণ-অক্ষর-শব্দ, এরা নিজনিজ গুণে একক সব অভিজ্ঞতার ভার বহন করে আর ব্যক্তিভেদে বিবিধ ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে, আর ভাষায় হেলান দিয়ে এই প্রভাবের চিত্রনাট্যটা লেখেন একজন কবি। মানে এই যে, এই লেখার খেলাটা যিনি খেলেন তিনিই কবি, একটা বিশেষ মনস্তত্ত্ব বয়ে বেড়ান কবিরা। এইটা সংসারে থেকেই করেন কেউকেউ, সংসারহীন কেউ-বা।
কবিতা আলো-অন্ধকার, দেখা-অদেখা, জানা-অজানা, চেনা-অচেনা যে—কোনো আকার বা নিরাকারকে লেখ্যরূপে উপস্থাপন করে থাকে, জগতের অন্যান্য কাজের মতোই এটা একটা কাজের ফলাফল। সেই কাজ কবির। অন্যরা তা করে না, তাই অন্যরা কবি নন।
এই লেখাটা হাইপোথেসিস বৈ বিশেষকিছু নয়। সত্যিই ব্যাপারগুলা এমন বায়োলজিকাল।
মালার্মে ইউরোপে যেই প্রতীকি আকার দিতে চাইছিলেন কবিতারে, সেই কাজটা এইখানেও সমভাবেই হয়েছে, আগে আর পরে, এটাই ভিন্নতা। মধ্যযুগ মোটেও শূন্যতা নয় এই ব্যাসিসে। আর চর্যাপদ একটা ইউনিক সম্পদ বিশ্বসাহিত্যে। রামায়ণ বা মনসামঙ্গল কোনটাই ফেলনা নয়। বাংলাকবিতা তার স্বরূপ নিয়ে রাজনীতি করেনি, বিধায় প্রাতিষ্ঠানিক সারবত্তার প্রসঙ্গে বাংলাকবিতা পিছিয়ে। এই পশ্চাদপদ উপনিবেশের শঠতার ফল বৈ কিছু নয়। আর, প্রভাব সে—যে কোনোভাবেই বিস্তৃত হতেই পারে। আদি বাংলার চিত্রশিল্পের স্বত্ব নিয়ে যেমন মধ্য এশিয়ার গৌরবরথ চালিত!
উপমহাদেশীয় শিল্পে বাংলাকবিতা সগৌরবে উজ্জ্বল আর বৈশ্বিক পটে সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির বর্তমান সমস্ত মানদণ্ড ইউরোপীয় শিল্পের আরোপিত সত্য, স্বয়ংক্রিয় নয়। হুইটম্যান বা নজরুল তার চেয়ে বামন নন, গোর্কি বা মানিক কেউই কারো চেয়ে হীন নন, বরং উঁচু দেখানোর চেষ্টাটা আরোপিত সত্যই একইভাবে।
মাইকেলের কাজ কোনোঅংশে এলিয়ট হতে নীচ নয়। আসলে মানদণ্ডের ধারণাটাই কৃত্রিম, এতটাই যে, একে বর্ণবৈষম্যের দোষ দেয়া কোনো দূষণ বা নৈরাজ্য নয় একদম।
শোকের পাথরলিপি আর মাটি, বাংলাভাষী;
এইসব মর্ম গীতলে বলো, কতোকাল গাইছো তুমিও সলো?
এই মরা নালিঘাস, চলিত ঘাসের ভাষা
উহ্য করেছে এক প্রজ্ঞার আবহাওয়া, আর সে-ই
হাওয়াময় ইলম জাগায় আত্মজিজ্ঞাসা, ঝিলমের পাড় আঁকা
দুই চোখ নিয়ে, এই হাঁটা, মুসাফির কারো নাকি?
কবরফলক ক্ষয়ে, কতোগুলো ঋতু, ফিরে গেছে নির্মোহে
বিষাদ-ঘুড়িতে দুলে, জানো এর প্রত্যুত্তর?
এইখানে নিথরতা আমি হলে যেন সেই বাঙ্ময়
জার্নি, পাড়ি দিই সাওম-শোভিত মুখে!
গ্রহ আর নক্ষত্রের ভাষা
নদী আর তরল মেঘের গাড়ি
মানুষের আয়ুবিষে নেমে, আয়ুর কাড়াকাড়ি
লিখে যাবো তার আগে!
সেটুকু নিছক দিও, সুযোগ আমাকে দিও!
এ’ই বলে আয়না আমাকে ডাকে, যেন এক প্রাচীন ভাষার নদী
এইদিকে গেঁথে গেছে মেঘে, এইরাত অমল তরণী চেনে?
বহুদূর, দিঘার কিনার ঘেঁষে, নাটমন্দির;
সে-ও কিনা চায় চিরল ধ্বনিত হতে, ঘাড় হেট করে
জোয়ার বালুকা ঢাকে, যেন ডাকে মৌরসিপাট্টা;
যেন তুমি পাঠ নিতে যেতে বহুদূর, সোমপুর;
সেখানে শুক্লপক্ষের চাঁদ একটানে এসে নামে, চর্যার অক্ষরে!
যেন ভোর নিজেই প্রতিমা ছিলো, আগজন্মে;
নিজেই বয়েছে পিঠে, মাহিসওয়ার!
হাতঘড়ি, থেমে গেছে সে-ই কবে, রাষ্ট্র কাটছে পোকা;
নাগরিক মানে বোকা, নাগরিক মানে দরদ উথলানো
বুকচাপা কান্নার প্র্যাক্টিস! ভুল করেছে যুবক? কী ভুল
ডোবালো তাকে?
হাই তোলে কতো রোদ্দুর!
হাই তোলে সিংহদরোজা কার?
নগরীর ফলিতবিদ্যা খুলে, যে নিজেই
করেছে আড়াল নিজেকে, করাল নিওর ঝরে
তার ফটো ঝাপসা দেখায়, কুয়াশায়!
সে-ও কিনা চাষাবাদ ভালোবাসে?
কী ভুল করেছে সে, যে আলো নাই, ভালোবাসা নাই-মতন
অপার নির্বাসন, নৈঃসঙ্গের যাবজ্জীবন, হুড খুলে ভিজছে সাথে
অটোরিকশায়!
হাই তোলে গোমতীর চর
ভিড় ঠেলে দখিনা বাতাস, পায়চারী করে, এইসব দিন
এইসব নিদ-জাগা ঘাসের ওপর, চুপচাপ বসে থাকে রাত, নিঃসঙ্গ;
কবিতা দাঁড়িয়ে একা, শহরটাকে খিস্তি করে—
হারানো শিশুর ডাক শুনে ফেলে মা, তদ্রূপ একার শোকে!
আমরা কতো মশকরা করতে শিখে গেছি সকালসকাল—
ডানে সরে যাচ্ছে মেঘ, ফুলতলার দিকে বৃষ্টি হবে হয়তো;
কাছেই কারো উচ্চারণের ভেতর, ঘূর্ণি খেয়ে ওঠছে, কুরসিনামার মেঘ!
আমরা হাত উঁচিয়ে কেউ ডাকছি কাউকে
হয়তো মাঠখোলা ঘাসের স্মৃতিকে পেয়ে
হর্ন বাজাচ্ছে অফিস-বাস!
তারপর শক্ত একটা ঝাপটাঅলা বাতাস
কব্জি ঘোরাতে ঘোরাতে এইদিকে আসে!
ফড়িং নেই, কাশফুলেরা হৃদয় হতে লাফিয়ে নামে
আর, তোমার চোখের তারায় হালকা ঢেউয়ের পুকুর
এইদিক চেয়ে প্রশ্নপত্র পাঠায়—
এত্ত সকালে, এত্ত গাড়ির তাড়াহুড়ায় বসে
এতসব আলোচনা ফেলে, তুমি কেনো আড়াল খুঁজছো বাজান?
পিতার ডাকের মতো মনোরম ভোর,
অদূর দরজা খুলে আসা রেলপথ, আর
‘লা আবুদু মা’তা বুদুন’—ধ্বনিত আয়াতে এসে
গতিধারা বেঁকে যাওয়া নদী আমাকে
জীবন আর অভিজ্ঞানের মধ্যে বসিয়ে রাখে
অনেকক্ষণ, প্রায় বিকালেই, অনেকক্ষণ!
ভাবি, মৃত্যুই সবশেষ নাকি? ভাবি, আনন্দ কি মানুষ অপেক্ষা ভারী?
কে—যে হাসে পৃথিবীতে, আর সমস্ত গান চোখে নিয়ে যেভাবে চাইছো তুমি, যেভাবে লগ্ন হতে ফিরে যায় দৃশ্যের বুলবুলি; আর মুখ ঢেকে দিয়ে অনন্ত মুখোশে, আমরা সকলে ঋণগ্রস্থ নই?
সঙ্কোচ-দ্বিধা-প্রত্যয় শেষে, নিয়তির যাত্রা হয়ে
মানুষ ফিরে যাবে মানবিক জ্যামে, ফিরে যাবে নাকি রবের উদ্যানে?
(কবি সাখাওয়াত টিপু, করকমলে)
তিনমাস হৃদপিণ্ডে আমি শুধু বৃষ্টিই চেয়েছি
ফিরে যেতে উদ্যত পা—
ফিরে গিয়ে অনেক আকাশ ফুঁড়ে, যেখানে ভ্রুকুটি, পরশ্রীকাতরতা
সকলই হলো, ধূলিচাপা পড়া ডায়েরির পাতা;
যেখানে হিজলের ডাল উঁচু হতে চেয়ে, পরমতে শিথিল করেছে মোহ; ফিরে যায় ভ্রম, জিকিরে ভ্রমণ এসে লগিনাড়া হাত পেয়ে থামে;
থামে আর ঢেউ, অভিলাষ হতে ছাড়াতে থাকে মৃতদের স্মৃতি!
এই তিনমাস, আমি শুধু পদ্মকে চাই, আমি চাই দিঘিটা এনে
সিঁড়ি ঠেকাবো তোমার পায়ে;
এটুকু সময় জ্বলজ্বল করে ঘাট, এখানে আম্মাকে শিশুতোষ পাই!
বৃষ্টির পানি পেয়ে খুলে নেন, কাতানে আঁকানো ফুল;
ভাসাবেন বলে, রৌদ্র ও লিকারে সাজাবেন বলে, নদী ও সুবিল;
আর, ‘রক্তক্ষয়ে মীমাংসা নেই, মিমাংসা থাকে না’ এইটুকু সরল চাহনি ছুড়ে
মায়া টাচ করা রমণীটি আমার মা!
অনেক আকাশ ফুঁড়ে, লওহে মাফুয;
ন্যায়-অন্যায়-প্রেম, প্রাচ্যকে ডাকে!
ডাকে নাকি শুধু? প্রাচীন শব্দের দল, হারিয়ে ফেলেছে তল?
দেখো, মাঠে ও মজ্জায় কার ডুবে গেছে আধারোপা ধান!
এই মেঘমালা, এইসব হিমালয়ধ্বনি, বৃষ্টিতে স্নাতকোত্তর?
এটুকু সময় ধরে ঝিরঝির বর্ষণ, শুনেছো আকাশবাণী?
চৌচির বাকল নিয়ে, ভেজছে একাই একটা গাছ
কান্নাও বুকের ভেতরে জমে ধূলাবালি কাদা হয়ে গেছে!
(প্রিয় আসাদ জামানকে)
কাছে এক মৃত্যুযন্ত্রণা এসে
থেমে থেমে ডাকে, মেঘের মতো ডাকে;
তুমি ছায়া, দূর সাইরেন, শেষতম রোদে!
কতোদিন কাছে এসে বসে কোলের ওপর, মাথা ঘঁষে যায়
পুরাতন গল্প ও গৌরব; যেন তাড়া নেই।
রুলটানা খাতার ভেতর যেন
ঘাপটি মেরে আছে পূর্ণ জীবদ্দশা, ট্রলারের ধোঁয়া, পাখিডাক!
আমাদের আলোহাওয়া ব্রিজ
সম্পর্কের নাম করে বুকের ভেতর
খুঁটি ধরে জেগে থাকে, বন্ধনে, কাঁপাস্বরে ডাকে;
আমাদের খোলামেলা হাসি, টেবিলে বিছিয়ে দিয়ে, কতোদিন
বসি নাই আর!
নিজে থেকে নিজনিজ চামড়া ছাড়িয়ে
ধুয়েমুছে গায়েই নিচ্ছি আবার, এইসব ক্রুটি বসন্তদিন
ধীর হয়! এভাবে স্মৃতির মিটারে জড়ো হয় পরিচিত মুখ!
বেসিনে এগিয়ে দিয়েছি মাথা
গোলগাল ট্যাপের নিচে, পানি পেলে
স্নায়ুর বিকার কমে।
এই দেখো, ক্ষতচুল্লির তলে সারাদিন ঘামছে জীবন, ততোধিক
একলা বোধের তলে গম্ভীর হয়ে আছে শিশুকন্যার মুখ!
সাজ্জাদ সাঈফ
জন্ম-২৯ জুন, ১৯৮৪, ঢাকা।
মনোরোগ ও মাদকাসক্তি রোগ বিষয়ে থেসিস পার্ট, স্নাতকোত্তর।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ :
কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা (২০১৭), তিউড়ি, ঢাকা।
মায়ার মলাট (২০১৯), জেব্রাক্রসিং, ঢাকা।
ভাষার সি-বিচে (২০১৯), গিলগামেশ, কলকাতা।
ব্যক্তির অন্তর্জগতের দোলা আছে কবিতাগুলোয়। দেশজ অনুষঙ্গে মূলত অন্তর্গত ভাবাবেশ কিছুটা দার্শনিক চিন্তা নিয়ে হাজির। ব্যক্তি ছাড়িয়ে যা-কিনা অধিবিদ্যার জানালায় উঁকি দিয়ে জীবনকে খুঁজতে চায়। এই অনুসন্ধ্যান ভালো লেগেছে। তবে কবি ‘ইউরোপীয় শিল্পের আরোপিত সত্য’ নিরূপন করেও তা নিজের কবিতায় এড়াতে পেরেছেন কি না, সেই প্রশ্নটি থেকে যায়। বিশেষত আঙ্গিক নির্মাণে ‘ইউরোপ শিল্পের’ দিকেই কিছুটা ঝুঁকে আছেন কি না, তা আরেকটু খতিয়ে দেখবেন আশা করি। তবে ‘হাস্য মুখে দাস্য’ গ্রহণ এড়াবার বাসনা আছে তার। এখানে কবির প্রতি ভালোবাসা রইলো।
প্রিয়জন কবি, আপনার পর্যবেক্ষণ মূল্যবান, তবে ইউরোপীয় ধাঁচ গ্রহণের জায়গাগুলি ধরিয়ে দিলে উপকৃত হই, আমি লেখার ক্ষেত্রে সজ্ঞানে জাত্যাভিমানী, ‘ইউরোপীয় শিল্পভঙী আরোপ’ বিষয়টাতে আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতে হায়েস্ট ট্রাই করে এসেছি আসলে…
প্রিয়জন কবি, আপনার পর্যবেক্ষণ মূল্যবান, তবে ইউরোপীয় ধাঁচ গ্রহণের জায়গাগুলি ধরিয়ে দিলে উপকৃত হই, আমি লেখার ক্ষেত্রে সজ্ঞানে জাত্যাভিমানী, ‘ইউরোপীয় শিল্পভঙী আরোপ’ বিষয়টাতে আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতে হায়েস্ট ট্রাই করে এসেছি আসলে…