জীবনের শুরুতে বাঙালি পল্টনে যোগদান কেবল সৈনিক নজরুলের পরিচিতি নির্মাণ করেনি, একই সঙ্গে তাঁর ভাষাবিশ্বেও এনেছে কূলপ্লাবী রণস্বর। তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ ‘চল্ চল্ চল্’ গানটিকে রণসংগীত নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে নজরুলের সাহিত্যিক রণস্বরের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশুদ্ধ সাহিত্যিক পরিসরে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। ‘বীণা’র সঙ্গে তিনি যে ‘অগ্নি’যোগ করে অগ্নিবীণার মাত্রিকতা দেন কিংবা ‘বাঁশী’র পূর্বে ‘বিষ’ যুক্ত করে বিষের বাঁশী নামের অভিনতুন শব্দবন্ধ তৈরি করেন তা তাঁর কোন বিচ্ছিন্ন নন্দনপ্রয়াস ছিল না, বরং তাকে আমরা গণচারিত্রের শিল্পসৃষ্টির প্রসূন জ্ঞান করতে পারি। এক কনফেশনাল বক্তব্যে নজরুল নিজেই বলেছেন—তিনি জন্মেছেন ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে’। তাঁর জীবন ও সৃষ্টিজুড়ে দেখি অসম্ভবকে সম্ভব করার নিরন্তর সাধনা। এই চেতনা থেকেই ব্যক্তি নজরুল দাঁড়িয়েছেন পরাক্রমী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বস্তুত সমগ্র নজরুল-জীবন ও সৃষ্টি সাম্রাজ্যবাদী চেতনাকাঠামোর বিরুদ্ধে এক সোচ্চার উচ্চারণের নাম। তিনি ১৯২২-এ বলেছেন—
স্বরাজ টরাজ বুঝিনা, কেন না, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগর পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেনা। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
এ শুধু কথার কথা ছিল না, বরং কবিতায়, গদ্যে, গানে, সাংবাদিকতায়, রাজনীতিতে এবং সর্বতোরূপে চেতনালোকে তিনিই সেই পূর্ণ মানব যিনি ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে চুল পরিমাণ আপোষ করেননি।
২
তিনি বলেছেন—
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবি’
কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি’!
নজরুলের সৃষ্টিশীলতায় অধুনান্তিক বৈশিষ্ট্যের উনতা নিয়ে যারাই তর্কপ্রবণ তাদের সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তাঁর কাছে নন্দনতাত্ত্বিক তর্কের চেয়ে গণলগ্ন ফসলের গান বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। নিজের সৃষ্টির সাহিত্যমান নিয়ে সচেতন না থেকে যদি নিজেই সৃষ্টি করা যায় নতুন সাহিত্যসড়ক—তার চেয়ে মহার্ঘ্য আর কী হতে পারে! নজরুল ত্রিশের কবি কতকের মতো রবীন্দ্রবিরোধিতায় নিমগ্ন না হয়েও নিজেই সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রোত্তর নিজস্ব কবিতাধারা। যার সম্পর্কে হুজুগেপনার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—
জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরিখ নয় কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।
কবিতার কথায় নজরুল সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের পর্যবেক্ষণ যথার্থ—
… যে বিশেষ সময়ধর্ম, ব্যক্তিক আগ্রহ ও একান্ততার জন্যে নজরুলের অনেক কবিতা সফল ও কোনো—কোনো কবিতা সার্থক হয়েছিল—জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় মূল্য ও মাত্রা চেতনায় খানিকটা সুস্থির হয়েও আজকের সময়রূপের জন্যেই নয়—আমাদের হৃদয়ও আমাদের বিরুপাচার করে, অনেক সময়ই আমাদের মনও আমাদের নিজেদের নয়; এই সাময়িকতার নিয়মই হয়তো তাই। কিন্তু ব্যক্তিকতা নজরুলের ও সময় এই বুদ্ধিসর্বস্বতার হাত থেকে তাঁকে নিস্তার দিয়েছিলেন। আধুনিক অনেক কবিতা থেকে তাঁর কোনো কোনো কবিতার অঙ্গীকার তাই বেশি, ধ্বনিময়তায়ও উৎকর্ণ না করে এমন নয়। কিন্তু নিজেকে বিশোধিত করে নেবার প্রতিভা নেই এ-সব কবিতার বিধানে, শেষরক্ষার কোনো সন্ধান নেই।
জীবনানন্দ নজরুলে খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃত রূপের রচনা যা কবিতার কাঠামোকে অতিক্রম করে নতুন সংজ্ঞাপথ দাঁড় করায়। নজরুলের রচনায় ব্যক্তিবাদ যে গণচেতনার সঙ্গে শিল্পশোভন অন্তর্লীনে একীভূত হয়ে গেছে তার নিগূঢ় ব্যাখ্যা-রসায়ন জীবনানন্দ দিয়েছেন, যার ঝরা পালক বইয়ে নজরুলের প্রভাব-বিভাব উপচে পড়েছে মুহূর্মুহু।
৩
২০১১-তে বর্তমান লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন ‘নজরুলের বিরহের গানও যেমন মজলিশে শোনার মতো আবার অধিকাংশ রবীন্দ্রসংগীতই একাকী নির্জনের’। তাঁর এই আবিষ্কারণ সঙ্গত ও ভাবনা-উদ্রেকী। বাংলা সাহিত্যে কেন, গোটা বিশ্বসাহিত্যেই গণস্বরকে এভাবে সাহিত্যস্বর করে তোলা অভূতপূর্ব ব্যাপার বটে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না—
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
বহুখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল সৃষ্টি করলেন নতুন ইতিহাস—একাধারে কবিতা এবং গণচেতনারও। ১৯২১-এর ডিসেম্বর উপান্তে বিদ্রোহী কবিতার রচনা শুরু এবং প্রথম প্রকাশ ১৯২২-এর ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এই কবিতায় অন্তত শতবার ‘আমি’র ব্যবহার সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। অবিস্মরণীয় একারণে যে ‘আমি’র অজস্র ব্যবহারও একে ব্যক্তিগত উচ্চারণের স্তর থেকে উত্তীর্ণ করেছে গণ-ইশতেহারে। নজরুলবিদ ড. রফিকুল ইসলামের আবিষ্কার তাৎপর্যবহ—
বিদ্রোহী কবিতায় কবির ব্যক্তিত্বের, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের, আত্মবিশ্বাসের, আত্মপ্রত্যয়ের, আত্মশক্তির উদ্বোধন জাগরণ ও প্রকাশ। এ কবিতায় কোন মহত্তম সত্তার কাছে আত্মসমর্পণে অনিচ্ছা ও অনীহা স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহের রূপকে বারবার প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়েছে আর শেষে পৃথিবী থেকে উৎপীড়ন ও অত্যাচার দূরীকরণের সংকল্প ঘোষিত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুরুতে আত্মগত, কবির আত্মজাগরণের মধ্য দিয়ে যার উদ্বোধন শেষের দিকে তা বস্তুগত, যেখানে কবি এ পৃথিবীতে উৎপীড়ন ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সব শেষে কবি শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির খামখেয়ালীর বিরুদ্ধে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে চিরবিদ্রোহী বীরের এবং চির-উন্নত শিরের মহিমা অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন—
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা জাগিয়ে তোলার কাজ করে। একটা কুঁজো লোকও কিন্তু ‘বিদ্রোহী’র ঝংকারে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। কবিতার কাজই কিন্তু তাই।
রচনার এত বছর পরেও বিদ্রোহী সমান আদৃত বাংলা কবিতার গণপাঠকের কাছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত উদ্যোগে উদ্যাপিত হয়েছে বিদ্রোহী কবিতার ৯০ বছর পূর্তি উৎসব। শুধুমাত্র এই কবিতাটি ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্পাদনাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে নজরুল ইন্সটিটিউট। একটি কবিতা যে তার অন্তর্গত সামার্থ্যে রচনারীতি ছাপিয়ে গণচেতনার সমার্থক হয়ে ওঠতে পারে বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে নজরুলের বিদ্রোহী তাঁর সুসার্থক উদাহরণ। বর্তমান লেখককে গত ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে চীনের বিশ্ববিশ্রূত রবীন্দ্র-অনুবাদক ও গবেষক অধ্যাপক ডং ইউ ছেন বলেন—
রবীন্দ্রনাথের মতো কাজী নজরুল ইসলাম আমার খুবই পছন্দের কবি। বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। নজরুলের সাহিত্য অনুবাদ করার ইচ্ছে আছে।
অনুধাবন করা যায়, বাঙালি পাঠক-গবেষকের পরিসর পেরিয়ে বিদ্রোহী দূর দেশ-মহাদেশের মানুষের কাছেও সমান আবেদন নিয়ে উপস্থিত হতে সক্ষম হচ্ছে তার অভ্যন্তরস্থ ভূগোলভেদী সর্বমানবিক গণস্বরের গুণে।
৪
সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার নজরুল এত অতি-আলোচিত যে কবিশিল্পী নজরুল এর ভিড়ে হারিয়ে গেছে প্রায়। অভিনিবেশি পাঠে টের পাই—রণরোলের যে কণ্ঠ বেজে ওঠে সমাজ-রাজনৈতিক পরিসরে; প্রেমের ক্ষেত্রে তা যেন বিধুর আত্মার উচ্চারণময়। রৌদ্রদগ্ধের গানের মতোই তিনি বলে উঠেন ‘হে আমার ব্যথা, তোমাকে নমস্কার’। এই ব্যথার দানেই নজরুলে অনন্য নন্দনসূত্র নিহিত। আজকের সাহিত্যতত্ত্বে বিচার করলে নজরুল সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা-প্রত্যালোচনাও জরুরি।
কলেজকৈশোরে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টের Tree at my Window কবিতার সঙ্গে নজরুলের বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি কবিতার আশ্চর্য মিল-প্রতিমিল আবিষ্কার করে বিস্মিত হয়েছিলাম। এভাবে নজরুল সাহিত্যেকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তুলনামূলক আলোচনায় প্রতিস্থাপন করলে আমাদের সাহিত্য-সমালোচনা আরো সুপ্রসর হবে বলে মনে করি।
ভাষাশিল্পী নজরুলও আমাদের অন্যতম আলোচ্য হওয়া উচিত। বাংলা ভাষাভ্যন্তরে যুগপৎ যে শক্তি ও লাবণ্যরসের অভূত বেণীবন্ধন ঘটিয়েছেন নজরুল, তার স্বরূপ উদ্ঘাটন হওয়া জরুরি। বাংলা ভাষার প্রয়োগসম্ভাবনা নজরুলের লেখার মধ্য দিয়ে নানাভাবে সাকার হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বলবন্ত ও কোমল এ ভাষারীতি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নয় বরং তার নিজস্ব নির্মিতি। নিরীক্ষামূলক এ ভাষা পাঠকসাধারণ যে বিপুল ভালোবাসায় গ্রহণ করে চলেছে তার আন্তঃরসায়নের খোঁজ পাওয়া গেলে শুধু নজরুলের নয়, আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষারও একটি অন্যতর দিগ্বলয় উন্মোচিত হবে।
৫
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সমকালে নজরুল শীর্ষক উন্মোচক গ্রন্থে প্রামাণ্য দেখিয়েছেন—কী করে তাঁর সমসাময়িক মৌলবাদীর দল নজরুলকে আক্রমণ করেছে। এদেরই বংশধরেরা যখন খণ্ডিত নজরুল নিয়ে ব্যবসায়ে লিপ্ত তখন আহমদ শরীফ সঙ্গতভাবে ‘নজরুল অহিফেন’ এর কথা বলেছিলেন। তাই নজরুল নিয়ে রচিত উদ্দেশ্যভারাতুর রচনার সতর্ক পাঠের পাশাপাশি ব্যক্তি নজরুলকে ভক্তিবাদী আবরণমুক্ত মানুষ নজরুল হিসেবে আবিষ্কার করতে হবে যিনি তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষণে বলেছিলেন—
যদি আর বাঁশী না বাজে—আমি কবি বলে বলছিনে—আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি আমায় ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি—আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম—সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চির দিনের জন্যে বিদায় নিলাম।
এই প্রেমঘন, রসঘন, আনন্দঘন অসাম্প্রদায়িক-সাম্যবাদী নজরুলকে পূর্ণ-প্রকৃত স্বরূপে আবিষ্কার এবং চর্চাতেই হবে আমাদের গণজীবনে তাঁর যথাযোগ্য স্মরণ ও প্রত্যাবর্তন।